আমার দিকে তাকিয়ে তুমি হাসতে,
আর কী আজব দ্যাখো-
আমাদের বাড়ির ওঠোনটা ভোরে যেমন আলোকিত হয়ে ওঠত,
তেমন আলোয় ভরে ওঠত তোমার সারাটা মুখ;
যেন, রূপকথার চাঁদের বুড়ির জাদু কাঠি ছুঁয়ে দিয়ে যেতো তোমার ঠোঁটে চোখে গালে,-
আমার পৃথিবীতে ভোরের পাখিরা তখন দুষ্টুমি আর খুনসুটিতে মেতে ওঠত!
জানো বাবা, এখনো আমার পৃথিবীতে ভোর নামে, পাখি গায়;
বর্ষার স্যাতস্যাতে অথবা শীতের বিষন্ন ভোর। এমন ভোরে পাখিরা গায় শুধু নিদ্রার গান।
তোমার কড়ে আঙুলে আর অনামিকা লটকে থাকত প্রতিটা সন্ধ্যায়,
আমি হাঁটতাম আমাদের বাড়ির সামনের ঘাসে ছাওয়া রাস্তা দিয়ে,
তুমি রাজকন্যাদের গল্প বলে যেতে...
আচ্ছা বাবা, তোমার রাজকন্যারা কি আজো ডাইনীর মায়াবল কাটিয়ে ওঠতে পারিনি?
মরে আছে ঘুমন্তপরীতে? রাজপুত্তুররা বুঝি পঙ্খীরাজ উড়িয়ে জিয়নকাঠি ছোঁয়ায় নি
তাদের শিয়রে?
অথচ দ্যাখো, তোমার রাজকন্যা, ইতিমণি, বন্দী আজ জীবনের কারাগারে!
তুমি তো জানো, তোমার আঙুলই জিয়ন কাঠি আমার জন্য-
তাদের মায়াবি ছোঁয়ায় আমি বারবার কতবার জেগে ওঠেছি!
দুঃস্বপ্নে তোমার কড়ে আঙুল কত হাতড়াই আরেকবার জেগে ওঠব বলে,
ঘাটের শলাকা, জানালার শিক ছাড়া কিছুই ঠেকে না হাতে!
আমার পৃথিবীটা ছিলো ওয়ার্ল্ড ডিজনীর বাম্বি, পিনোকী, স্নো হোয়াইটদের নিয়ে গড়া রঙিন রূপকথার মতো,
আর আজ, পাশের বাড়ির মুদির দোকানীর পৃথিবীর মত সাদা কালো...
কেননা, বাবা তুমি, আমার শৈশবের রূপকথার জাদুকর,
নিজেই আস্ত এক রূপকথা হয়ে গেছো।
তুমি কী আর সত্যি মানুষ হয়ে জেগে ওঠবে না, বাবা?
আমি এই নিষ্ঠুর নিয়ন আলোর শহরে একাকি ঘুমিয়ে যে আছি!
আমাদের বাড়ির ওপরে আমার নিজস্ব যে আকাশটা আমাকে দিয়েছিলে একদিন,
কতদিন দেখি নি সে আকাশ!
এখন এই ভিনদেশী আকাশ হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের আড়ালে মুখ ভেংচায়;
আমার আকাশের তারার আলোর নিচে বসে তুমি কতদিন রূপকথা শোনাও না!
এখন সারা শহর নিয়ন আলোয় ভরে থাকে,
এত ঝলোমলো শহরে
বেঁচে আছি আমার আকাশের স্মৃতি নিয়ে,
তোমার স্মৃতি নিয়ে।
হয়তো, একদিন এই নিয়ন আলো
চোখে ঠুলি পরিয়ে ভুলিয়ে দেবে আমার রামধনুর আকাশের স্মৃতি!
সেইদিন কর্পোরেট নিরবতা পালন করব কয়েক মিনিট,
এবং, ক্ষমা করো বাবা,
তোমার স্মৃতির ভার আর সইতে পারছি না।
-অপরিচিত মানবী
০৬/০৫/১৩