কালচে রঙের বাসটার ঠান্ডা কাঁচে মাথা ঠেকিয়ে বাইরের শপগুলোর দিকে ইতিমণি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। বাইরে পড়ন্ত বিকেলের রূপ ঝরে পড়ছে। এই শহরের সবাই কী যেন এক ব্যস্ততায় সবসময় ছুটতে থাকে। একটু আগে লালমুখো এক বাচ্চা মায়ের হাত ধরে শপে ঢোকার সময় তাদের বাসের দিকে কচি আঙ্গুল তুলে মাকে কী যেন দেখাচ্ছিল। মা তাকে পাত্তাই দিল না, দৃষ্টির সামনে থেকে দ্রুত কোথায় যেন মিলিয়ে গেল তারা। আচ্ছা, বাচ্চাটি ওমন করে আঙুল তুলে কী দেখাচ্ছিল? নিউ ইয়র্কের কমলালেবুর মতো হলদেটে আকাশের নিচ দিয়ে বাসটি কখন যে বাড়িমুখো চলতে শুরু করেছে এতক্ষণ সে টেরই পায়নি। কাঁচে ঠেকিয়ে রাখা মাথা কয়েকবার ঝাঁকুনি খেলে কপালের চামড়ায় টান পড়ে আর সাথে সাথে টের পায় বাইরের দোকানপাট মানুষজন দ্রুত সরে সরে যাচ্ছে। মাথাটা তুলে পেছনের সিটে হেলান দিতেই খেয়াল করল কাঁচের যে জায়গাটায় নাক গিয়ে ঠেকে ছিলো সেখানটা শীতের ধুয়ো ওঠা নিঃশ্বাসে সাদা কুয়াশা ঘন হয়ে আটকে আছে। সেখানে সে মধ্যমা আঙ্গুল দিয়ে আস্তে করে লিখে দিলঃ
F**K FRIENDSHIP!
শীতের নিস্তেজ রোদ আদুরে বেড়ালের মত বাসের জানালা টপকিয়ে ইতিমণির কোলে এসে পড়ছে। সেদিনও এমন রোদ ছিল কিনা ঠিক মনে নেই, খুব সম্ভব, কড়কড়ে রোদ ছিল। তার মা কী এক কাজে মার্কেটে চলে গেলে সে আর স্কুলে যায় না। বরং সুমিয়াকে সাথে নিয়ে মিরপুরের মুড়ির টিন খ্যাত বাসে করে বেড়াতে যায়। এত লোক আর কোলাহলের মাঝে দুই সখীর সাদা মোজাপড়া আনন্দে উচ্ছ্বসিত দুটি পা ঝুলতে থাকে। হঠাত্ কার যেন হাতের স্পর্শে পেছন ফিরে তাকালে সাদা মোজার পা দু'জোড়া থমকে যায়। ঠোঁট শুকিয়ে ফেলা ভৌতিক শব্দের মত একটা আওয়াজ তার কানে ডুকে মাথা ঝিম ধরায়ঃ
'বাড়ি চল!'
কী রকম পাগলামো ভরা দিনগুলোই না ছিল ছেলেবেলাটা, এখন ভেবে হাসি পায়। এই যেমন, মা যখন তাকে ওমন পাকড়াও করে বাড়ি নিয়ে যায়, সুমিয়া এইটুকু বয়সেই কী বুঝে সারা রাস্তা একটা কথাও বলে না। অন্য রুম থেকে ইতির ভয়ার্ত কান্নার শব্দ শুনে দৌঁড়ে গিয়ে ইতির মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, 'ওর বদলে আমাকে মারুন আন্টি।' সেদিন মায়ের মারের ব্যথায় যত না চোখে জল এসেছিল তার থেকেও বেশি জল গড়েছিল সুমিয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে থেকে। আর বেচারা শুভ, যে কিনা মার শাড়ি পড়ে আমাদের পাঁচ বান্ধবীর মত মেয়ে সাজতে পেরে কী খুশিই না হত! মেয়ে সেজে খুশি হবার মত বোকাসোকা হলেও আমরা কিন্তু খুব মজা করতাম। আজো ইতির স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন বাসায় কেউ ছিল না; এই সুযোগে শুভর দিকে চোখ নেড়ে নেড়ে সে তার সাথে ছাদে যাবে কিনা জানতে চায়। ওরা যখন ছাদের কার্নিস ঘেঁষে দাঁড়ায় শুভ চিন্তিত স্বরে জিজ্ঞেস যে, ওরা যদি পড়ে যায় তখন কী হবে? কোনো ভাবনা চিন্তা ছাড়াই ইতি নিশ্চিন্তে বলে দ্যায়, 'কেন বোকা, তুই বাঁচাবি আমাকে আর আমি তোকে!'
এখন বুঝি ঢাকা শহরটা উঁচু উঁচু কর্পোরেট বিল্ডিঙে ছেঁয়ে গেছে? এক টুকরো আকাশ দেখার জন্য অনেক কষ্টে নাকি দৃষ্টিকে অনেক দূরে ছুঁড়ে দিতে হয়! দালানের আড়ালে সূর্য ওঠে আবার আড়ালেই ডুবে যায়! তখন তো এত ধুঁয়ো আর এত উঁচু উঁচু দালান ছিল না। বরং ঢাকার আকাশেও ঘুড়ি উড়ত; সেদিনও উড়েছিল। একটা ছেঁড়া ঘুড়ি শুভদের ছাদের দিকে উড়ে আসতে দেখে খুশিতে লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচে নেমে যায়। একা ছাদে ইতি একদম কার্নিস ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাস্তার মানুষজনের চলাচল দেখতে থাকে। ছাঁদের উপর থেকে গাছপালার মাথা দেখার আলাদা একটা মজা আছে। নিজেকে এখন তার দুনিয়ার সবার থেকে বড় মনে হচ্ছে। শুভ সিঁড়ি ভেঙ্গে কিছু দূর নিচে নেমে আবার কী ভেবে যেন দৌঁড়ে ছাঁদে ফিরে আসে; ঘুড়ির আশা ছেড়ে দিয়েছে বোধহয়।
'এইইই তুই ওখানে ক্যান?' ওহ... তাই তো, এখানে যে সে কেন তা ভেবেই পায় না। এই যা, একটু হলেই তো পড়ে যেত! দৌঁড়ে গিয়ে শুভ ইতিকে জড়িয়ে ধরে আর পাগলের মত তার সে কী কান্না!
না, সেই রাত্রের কথা আজো ভুলে নি ইতি। দুইদিন জ্বর থাকাতে স্কুলে যায়নি। আর কোথা থেকে খবর পেয়ে রাত্রেই এই টুকুন মেয়ে, সুজানা, মিরপুর ১০ থেকে মিরপুর ১১ তে ছুটে গিয়েছিল। সেইদিন ইতির কী যে ভালো লেগেছিল যেন অর্ধেক জ্বর তার সেরেই গিয়েছিল!
২.
নিউ ইয়র্কের রাত্রির নিয়ন আলোয় ব্যস্ত মানুষগুলোর দিকে তাকাতে আজকাল ভয় পায় সে। এত এত ব্যস্ততা, এই যে অন্ধের মত ছুটে চলা- এইসব যেন কী এক ধ্বংসের ইঙ্গিত বয়ে বেড়ায়। এই ব্যস্ততায় তার বন্ধুরা ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ছেলেবেলায়, বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে, কারোর ব্যক্তিগত কোনো জীবন ছিল না; এখন প্রত্যেকের একটা করে ব্যক্তিগত জীবন তৈরী হয়ে গেছে। সবাই তাদের ব্যক্তিগত জীবনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইতি তাই একাকিত্বের অতল সাগরে বিশাল বড় জাহাজের একমাত্র নাবিক এবং যাত্রী হয়ে শূণ্য চোখে সামনে তাকিয়ে থাকে।... কতক্ষণ ধরে যে বাস চলছে ঠিক ঠাহর করতে পারছে না ইতি। রোদ এখন তার কোল ছেড়ে বেশ দূরে সরে গেছে। শূণ্য চোখে ইতি বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে, কী এক অদ্ভুদ ভাবনায় ডুবে থাকে, বাইরের কিছুই আর খেয়ালে আসেনা।
অন্তর্জালে পরিচয় হওয়া বন্ধুদের আন্তরিকতায় সে বেশ মুগ্ধ হয়। ভাবে, এত অল্পতে এমন আন্তরিক বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপারই বটে। নিজেকে ভাগ্যবতী ভাবতে থাকে। স্কিনের অপর পাশে থাকা কথিত আন্তরিক বন্ধুগুলো চোখ কচলে ইতির প্রোফাইল নামটি দেখতে থাকে। ইতিমণি জানে না, মানুষ কী চমত্কার বন্ধুত্বের অভিনয় করতে পারে! সে মনের মত বন্ধু পেয়ে গল্পের ঝুড়ি নিয়ে বসে। কত কত কথা জমে আছে তার। কাজের ফাঁকে, ক্লাশের টিফিনে, ঘুমের আগে, রান্নার মাঝে- শুনিয়ে যেতে থাকে গল্পের পর গল্প। কথিত বন্ধুটির কথাও অবশ্য সে মনোযোগ দিয়ে শুনে। মনের মত বন্ধুর কাছে জমানো একাকিত্ব বিষন্নতা সুখী হবার অনুভূতি- এইসব শেয়ার করতে পারেনি বলে কী যে মন খালাপ করে থাকত! বালিকার মত উছ্বাসে সে গল্প বলে যায়। কথিত বন্ধুটি গল্পগুলো শুনে; মাঝে মাঝে চুক চুক আহারে...করে, মজার মজার কথা শোনায় ইতিকে। এইসব আন্তরিক বন্ধু পেয়ে ইতি নিজেকে খুব সুখী ভাবতে থাকে। অপরপ্রান্তে, কথিত বন্ধুটি মিটিমিটি হাসে। একদিন ইতিমণির প্রায় সমস্ত পেটের কথা জেনে যায় সে অথবা তারা। কিছুদিন পর ইনিয়ে বিনিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে তার অথবা তাদের সমস্যার কথা ইতি বান্ধবীর কাছে শেয়ার করার নাম করে পরোক্ষভাবে HELP চায়! কথিত বন্ধুর সাংকেতিক কথা শোনে, বুঝতে পারে তার সমস্যার কথা। না দেখা বন্ধুটির প্রতি মমতায় ভরে ওঠে তার মন, 'আহা বেচারা!' নির্দ্বিধায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দ্যায় সে। বন্ধুটি খুশি চাপা রেখে মনে মনে বলে ওঠে, 'মিশন সাকসেসফুল!' চোখে মুখে তার সুখের ঝিলিক কল্পনা করে ইতিমণি তৃপ্তিতে সে রাতগুলোতে ঘুমোতে যায়। বন্ধুটি রাত জেগে দিন জেগে আগের মতোই সঙ্গ দিতে থাকে অথবা বন্ধুত্বের অভিনয় করতে থাকে তার সাথে...তারপর একদিন যখন কথিত বন্ধুটি বুঝতে পারে, এর বেশি আর মেয়েটি তার জন্য করতে পারবে না, তারপর থেকেই আস্তে আস্তে বন্ধুত্বের আন্তরিকতা কেমন যেন ফিকে হতে থাকে! বন্ধুত্বের হারমোনিয়াম আর বাজে না, যেটা কিনা সম্প্রতিও কীসব বিচিত্র সুরে মোহিত করে রাখত। ইতি আসল ব্যাপারটা একদিন বুঝতে পারে এবং অনুভব করে মানুষের প্রতি নির্মল বন্ধুত্বের আস্থা হঠাত্ করে পম্পেই নগরীর মতো ধ্বসে গেছে। নিজেকে অতল একাকিত্বের সাগরে পুনরায় আবিষ্কার করে...
সে তার একাকিত্বকে ভরিয়ে তোলার জন্য সামান্য আগ বাড়িয়ে হলেও বন্ধুত্বকে দৃঢ় করত; আর এটাই কিনা তারা তার দূর্বলতা ভেবে বসত; ভাবত, মাইয়া বুঝি পটে গেল! বন্ধুত্বকে প্রণয় লিপ্সা ভেবে তাকে বগলদাবা করার অপেক্ষায় থাকে... একসময় তারা হতাশ হয়ে কেটে পড়ে!
তার এবং তাদের কথা ভাবতেই বমি চলে আসে তার। দৌঁড়ে বাথরুমে গিয়ে বেসিন ভাসায়।
৩.
বাস থেকে নেমে ক্লান্ত বিষন্ন ইতিমণি বাসায় ফিরে। চোখে মুখে পানি দিয়ে আয়নায় সামনে দাঁড়ায়। পেছনে তার ছায়া ছাড়া আর কাউকে খুঁজে পায় না। ছায়ার দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। খুব করে শৈশবে ফিরে যেত ইচ্ছে করছে তার। ময়লা বাস, মায়ের শাসন আর বন্ধুদের নির্মল হাসি, তাদের কাঁধে কাঁধ ঠোকাঠুকি করে শৈশবের রাস্তায় হাঁটতে ইচ্ছে করছে; যেখানে কারোর কোনো ব্যস্ত সমস্ত ব্যক্তিগত জীবন নেই। সবাই মিলে এক। মন আনমনে গেয়ে ওঠে-
বন্ধু তোমার চোখের মাঝে চিন্তা খেলা করে
বন্ধু তোমার কপাল জুড়ে চিন্তা লোকের ছায়া
বন্ধু তোমার নাকের ভাঁজে চিন্তা নামের কায়া
বন্ধু আমার মন ভালো নেই তোমার কি মন ভালো
বন্ধু তুমি একটু হেসো একটু কথা বল
বন্ধু আমার বন্ধু তুমি বন্ধু মোরা কজন
তবুও বন্ধু মন হলনা আপন
বন্ধু আমার বুকের মাঝে বিসর্জনের ব্যথা
বন্ধু তুমি ওমন করে যেও না আর একা
বন্ধু এস স্বপ্ন আঁকি চারটা দেয়াল জুড়ে
বন্ধু এস আকাশ দেখি পুরোটা চোখ খুলে
বন্ধু এস জলে ভাসি বুক ভাসানোর সুখে
বন্ধু তোমার বন্ধু আমি বন্ধু মোরা কজন
তবুও বন্ধু ভাসি নাকো আঁকি নাকো স্বপন।
থাক, ছেলেবেলার বন্ধুরা কচি ঘাস হয়ে বুকের বামপাশে। ইচ্ছে হলেই, স্মৃতির বাগানে হেঁটে বেড়াবে আর নিঃশ্বাস ভরে শৈশবের ঘ্রাণ নেবে সে। কিন্তু, সে বুঝে গেছে পেছনের ছায়াটিই তার একমাত্র বিশ্বস্ত সারা জীবনের বন্ধু!
No comments:
Post a Comment